নকশি কাঁথা
নকশি কাঁথা বাংলাদেশের লোক ও কারু শিল্পের ঐতিহ্যমন্ডিত ও নান্দনিক নিদর্শন। পুরনো কাপড়ের কাঁথা সেলাই করে তার ওপর গ্রামবাংলার মহিলারা বিভিন্ন নকশা তোলেন-একেই বলে নকশি কাঁথা। এই নকশি কাঁথায় জড়িয়ে থাকে অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি। উনিশ শতকের কিছু পুরনো কাঁথায় উজ্জ্বল চিত্রযুক্ত নকশা দেখা যায়, যা কাঁথাফোঁড়ে চমৎকার উদ্ভাবনী কুশলতায় তৈরি করা হয়েছে। কাঁথাফোঁড়ের নৈপুণ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে তৈরি হয়েছে হালকা তরঙ্গ, রঙের ভুবন, বিচিত্র বর্ণের বিন্দুনকশা ও বয়নভঙ্গি, যা দেখতে মনে হয় হাতে সেলাই করা নয়, তাঁতে বোনা।
কাঁথা তৈরি হয় সাধারণত পুরনো কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি ও ধুতি দিয়ে। সাধারণ কাঁথা বছরের সব সময়ই ব্যবহূত হতে পারে, কিন্তু নকশি কাঁথা বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহূত হয় । প্রয়োজনীয় পুরুত্ব অনুযায়ী তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরীভূত করে সাধারণ ফোঁড়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং সেলাইগুলি দেখতে ছোট ছোট তরঙ্গের মতো। সাধারণত শাড়ির রঙিন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে শাড়ির পাড়েরই অনুকরণে নকশা তৈরি করা হয়। তবে কাপড় বোনায় ব্যবহূত সুতাও কাঁথার নকশা তৈরিতে ব্যবহূত হয।
ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, খুলনা, রাজশাহী, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, দিনাজপুর, বগুড়া প্রভৃতি জেলায় তৈরি হয় বিচিত্র ধরনের নকশা সংবলিত কাঁথা। এসব নকশি কাঁথার ব্যবহার ভেদে বিভিন্ন নামও রয়েছে। যেমন গায়ে দেয়ার কাঁথা, বিছানার কাঁথা, শিশুর কাঁথা, সুজনী কাঁথা, বর্তনী রুমাল কাঁথা, পালকর কাঁথা, বালিশের ঢাকনি, দস্তরখানা, পান পেঁচানী, আরশীলতা প্রভৃতি।
কাঁথা সাধারণত বিছানা হিসেবে এবং অল্প শীতে হালকা চাদর হিসেবে ব্যবহূত হয়। আকার ও ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে কাঁথার বিভিন্ন নাম হয়। লেপ-কাঁথা ও শুজনি-কাঁথা আকারে বড় এবং লেপ-কাঁথা হয় মোটা, আর শুজনি-কাঁথা হয় পাতলা। এক বর্গফুট আকারের কাঁথার নাম রুমাল-কাঁথা। এ ছাড়া আরও আছে আসন-কাঁথা– বসার কাজে ব্যবহূত হয়; বস্তানি বা গাত্রি– কাপড়-চোপড় বা অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ঢেকে রাখা হয়; আর্শিলতা– আয়না, চিরুনি, কাজলদান ইত্যাদি ঢেকে রাখার কাজে ব্যবহূত হয়; দস্তরখান– খাবারের সময় মেঝেতে পেতে তার উপর খাদ্যদ্রব্য ও বাসন-কোসন রাখা হয়; গিলাফ– খাম আকৃতির এ কাঁথার মধ্যে কুরআন শরিফ রাখা হয় এবং জায়নামাজ– যার উপর বসে নামায পড়া হয়।
কাঁথায় ব্যবহূত পুষ্প মোটিফ ছাড়াও আবর্তক মোটিফগুলি হচ্ছে: স্বস্তিকা, কুলো, অলঙ্কার, হাতি, বাঘ, ঘোড়া, ময়ূর, নৌকা, জগন্নাথদেবের রথ, নৃত্য, শিকার, নৌকা বাইচ, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি হিন্দু দেবতা এবং হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্য। মোটিফ এবং দৃশ্যবিহীন জায়গাগুলি তরঙ্গায়িত কাঁথাফোঁড়ে সেলাই করা হয়।কাঁথা মোটিফগুলির মধ্য দিয়ে শিল্পিমনের বিভিন্ন আবেগ ও অনুভূতি প্রতিফলিত হয়। কাঁথায় যে পৌনঃপুনিক মোটিফগুলি দেখা যায় তার অনেকগুলি বিভিন্ন উৎসব ও ব্রত উপলক্ষে অঙ্কিত আলপনা শিল্পেও ব্যবহূত হয়। এ মোটিফগুলি সূচিশিল্পীর সুখ, সমৃদ্ধি, বিবাহ এবং মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে।