শখের হাঁড়ি

শখের হাঁড়ি চিত্রিত মৃণ্ময় পাত্র। বাঙালির জীবনসম্পৃক্ত বিবিধ শৌখিন শিল্পোপকরণের মধ্যে শখের হাঁড়ি অন্যতম। এর রং, নকশা এবং মোটিফের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় চিরায়ত বাঙালি মানসের হারিয়ে যাওয়া আদিমতম ইতিহাসের স্মারক। আকার-আকৃতির দিক থেকে সাধারণ হাঁড়ির মতো হলেও এর গায়ে উজ্জ্বল রঙ দিয়ে দৃষ্টিনন্দন চিত্র আঁকা হয়।  উৎসবপ্রিয় বাঙালির প্রতিদিনের জীবন, ধর্ম-সংস্কৃতি, আনন্দ-বেদনা এবং চিন্তার সাথে শখের হাঁড়ি একাকার হয়ে আছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলভেদে মাটির তৈরি পাত্রের নানা বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য গড়নে, অলংকরণে ও আকারে লক্ষণীয়। নিছক ব্যবহারিক উপকরণ বা শখের বহির্প্রকাশ নয়; ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় তাগিদ, বৈদিক আচার এবং শাস্ত্রীয় নানা আনুষ্ঠানিকতাও এর সাথে যুক্ত রয়েছে। এসব পাত্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচার, সংস্কার, ধর্ম, অনুষ্ঠান, উৎসব সম্পর্কিত। মৃৎপাত্রে অলংকরণ, রং এর ব্যবহার, মোটিফসমূহের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রকৃতির ও লোকজীবনের পরিচয় মৃৎশিল্পী তার তৈরি মৃৎপাত্রে ফুটিয়ে তোলে।

বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের দিকে লক্ষ্য করলে পরিদৃষ্ট হয় যে এটি দৈনন্দিন ব্যবহার্যতা থেকে নান্দনিক অলংকরণের মাধ্যমে উপকরণ হিসেবে সাধারণ থেকে অসাধারণ সৌন্দর্য সুষমা ও মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। বাঙালি লোকজ এবং সামাজিক উৎসব-পার্বণে ব্যবহার হয় এই পাত্রটি। অঞ্চলভেদে এর নকশার ভিন্নতা দেখা যায়। রাজশাহীর পবা থানার বসন্তপুরের হাঁড়িগুলোতে হাতি, ঘোড়া, পাখি, মাছ, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, বিভিন্ন ধরনের ফুল, নকশি লতাপাতা, শাপলাফুল, প্যাঁচা, কবুতর, চড়ুই পাখি ইত্যাদির প্রাধান্য থাকে। আবার গোয়ালন্দের হাঁড়িগুলোতে নকশি লতাপাতা, ফুল এর প্রাধান্য থাকে। নওগাঁর বাঙ্গালপাড়ার তাদের হাঁড়িগুতে লাল রঙের ওপর সাদা কালো ও সরষে ফুলের রঙে আঁকা হয় মাছ, চিরুনি, পাখি, পদ্মফুল।

নিত্য ব্যবহার্য হাড়ি-পাতিল, ঘটি-বাটি, শানকি, কলসি, পোড়মাটির পুতুল, মাটির মূর্তি, অলংকৃত পোড়ামাটির ফলক, মাটির প্রদীপ ইত্যাদি প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ তার জীবনযাপনের প্রয়োজনে নদীর পলি কাদামাটি দিয়ে তৈরি ও ব্যবহার করছে। প্রতিটি সামাজিক-পারিবারিক উৎসব থেকে জাতীয় সকল উৎসবের মাঝেই স্থান করে নিয়েছে এটি। শখের হাঁড়ির সৃষ্টির সংগে সম্পৃক্ত আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট শিল্পীর অনুভূতি ও চেতনার ঐতিহ্যের প্রবাহমান ধারাকে অনুসরণ করিয়েছে। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নাচ এবং লোকজীবনচিত্রের উপস্থাপনায় শখের হাঁড়ির অনুপস্থিতি কল্পনাই করা যায় না।