দারুশিল্প
দারুশিল্প কাঠের গায়ে খোদাই করা নকশা। কাঠ বা দারু একটি জড় পদার্থ হলেও মানুষ তা খোদাই-এর মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহূত খাট-পালঙ্ক, সিন্দুক, চৈত্য, নববধূর সিঁদুরদান, গৃহের আসবাব ইত্যাদি ছাড়াও কাঠের খুঁটি, শুঁড়ো, গৃহের স্তম্ভ প্রভৃতির গাত্র অলঙ্করণে দারুশিল্পের ব্যবহার দেখা যায়। বৈঠকখানা, শয়নকক্ষ ও খাবার ঘরের জন্য নির্মিত হতে থাকে স্বতন্ত্ররূপের অলঙ্কৃত আসবাবপত্র। আঠারো ও ঊনিশ শতকে এ ধরনের আসবাবের প্রতি আকর্ষণ শুধু উচ্চবিত্ত বা জমিদার শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, এর প্রভাব ভারত তথা বাংলার সকল শ্রেণির মধ্যে বিস্তার লাভ করে। জনগণ তাঁদের সাধ্যমত বিদেশি নকশার অনুকরণে আসবাবপত্র তৈরি করতে থাকেন। বিদেশি প্রভাবে আসবাব তৈরি হলেও গ্রামবাংলায় লোকায়ত শৈলীতে আসবাবপত্রের নির্মাণকার্য অব্যাহত থাকে। গ্রামবাংলায় দারুশিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব শৈলীর সঙ্গে বিদেশি নকশার সম্মিলন ঘটিয়েছেন, আবার কখনও শুধু লোকায়ত শৈলীতে বেড়া, সিন্দুক, খাট-পালঙ্ক, ঢেঁকি, প্যানেল ইত্যাদি তৈরি করেছেন।
দারুশিল্পে লোকায়ত নকশার মধ্যে পশুপাখি, দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য, বনফুল, কলমিলতা, লৌকিক দেবদেবী ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্মীয় কাহিনী অবলম্বনেও দারুশিল্পে খোদিত হয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। এর মধ্যে রাধাকৃষ্ণ, কৃষ্ণের বস্ত্রহরণ, কৃষ্ণের গোচারণ দৃশ্য, দধিমন্থন, গৌর নিতাই, দুর্গা অন্যতম। এছাড়া কিছু প্রতীকধর্মী নকশাও দারুশিল্পে দেখা যায়। যেমন জোড়া পাখি, ময়ূর, বাঘ, সিংহ, হাতি, অশ্ব, তরঙ্গায়িত লতা, বৃক্ষ, মঙ্গলঘট, সর্প, পদ্ম, ফুটন্ত পদ্ম ইত্যাদি। বিদেশি প্রভাবে তৈরি নকশার মধ্যে তরঙ্গায়িত পুষ্পলতা, কলকা, পেঁচা, সর্প, বোরাক, ফুলদানি হতে উত্থিতফুল, জালিকাজ, অ্যাকান্থাস, প্যাটেরা নকশা, পায়া নকশা, থাবাযুক্ত পায়া, ভিক্টোরিয়ান পায়া, ক্যান্ডিলাব্রা নকশা, জ্যামিতিক নকশা, আঙুরলতা ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে।